- 12 October, 2022
- 0 Comment(s)
- 362 view(s)
- লিখেছেন : তামান্না
চারিদিকে রাশিরাশি আনন্দ, মহাসমারোহে চলছে দেবীর আরাধনা। দুটি বছর পর উৎসব জমে উঠেছে। বাহ! কতই না বাহার, এত আনন্দের মধ্যেও একটা কিন্তু কিন্তু ভাব রয়েই গেছে। সারাবছর নিজের ইচ্ছামত নারীকে তোষণ করার পর, পুজোর কয়েক দিন দেবীর ভজন করার মধ্যে সত্যিই সুখানুভূতি আসে! বছর জুড়ে তর্জন, গর্জন, ছলচাতুরীর মধ্যে দিয়ে দশভুজাদের হাজার দশেক ঘরে বাইরের কাজ করিয়ে নিয়ে, রূপে লক্ষ্মীদেরকে পটের বিবি সাজিয়ে লোকসমাজে উপস্থাপন করে, তাঁদের কাজের কোনও স্বীকৃতি না দিয়ে, দুটি প্রশংসা বাণী না শুনিয়ে, কেবল দুহাত ভরে সেবা নিতে নিতে, গোঁফে তা দিতে দিতে, পিতারা মাথার উপর ছড়ি ঘোরাবেন; এতে তো আর দ্বিমত থাকতে পারে না!
পরিবারগুলি ছোট থেকে কন্যাদের তালিম দেন দশভুজা হয়ে ওঠার। পড়াশোনা, গান-বাজনা, ঘরের টুকিটাকি কাজ, ঠারেঠোরে বিয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন— এসব নিয়ে একটি কন্যা শিশুর জীবন শুরু হয়। অপরদিকে তাকালে কিন্তু অন্য এক দৃশ্য! হয়তো এখনকার আধুনিক বাবা-মায়েরা পুত্রশিশু ও কন্যাশিশুর মধ্যে ফারাক করছেন না, পুত্রশিশুও হয়তো কন্যাশিশুর মত তালিম পাচ্ছে। তবুও, কিন্তু থেকে যাচ্ছে। সেই আমরা আধুনিক, সচেতন হয়েও নীল, গোলাপির দুনিয়া তৈরি করে রেখেছি। বার্বি ডল, কিচেন সেটস, বন্দুক, যুদ্ধযুদ্ধ খেলার মধ্যে আমরা কী ছেলে মেয়েদের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে দিচ্ছি না? একটি শিশু ছোট থেকে দেখছে, ঘরে-বাইরে সমানতালে নারীরা কাজ করছেন। অপরদিকে বাড়ির পুরুষরা বাইরে কাজ করছেন, ঘরের কাজে তাঁদের অংশ গ্রহণ প্রায় নেই বললেই চলে। এদিকে আমরা আবার আমাদের আশেপাশে কেবল দুর্গা, লক্ষ্মীদের অনুসন্ধান করি। দশহাতে দুর্গারা কাজ সামলাবেন, রূপে লক্ষ্মীরা পরিপাটি করে অপরূপা সেজে, গুছিয়ে সংসার পরিচালনা করবেন। দেবীর আসনে বসিয়ে, নারীদের সুবিধা-অসুবিধা না দেখে, কলুর বলদের মত খাটিয়ে নিয়ে, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তাঁদের কার্যসিদ্ধি করে যাচ্ছেন! মহিষাসুরকে বধ করার জন্য মহাদেব থেকে শুরু করে স্বর্গের সকল দেবতা তাঁদের শক্তি দুর্গাকে উপহার দেন। কিন্তু আমাদের সমাজে যেসমস্ত কাজ কেবলমাত্র 'নারীদের' বলে, তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেসকল কাজের ভার নিতে, নিজের শক্তি সামান্য অপচয় করে, নারীদের শক্তির সঙ্গে পিতারা তাঁদের শক্তি যোগ করে কেন একীভূত হলেন না?
এই ছলচাতুরী দেখে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় আমাদের কাছে, সে স্বর্গ হোক কিংবা মর্ত্য সব জায়গাতেই নারীরা অসহায়! স্বর্গে দেবতাগণ, মর্ত্যে পুরুষেরা আসল কলকাঠি নাড়েন। এইসব দেখেশুনে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হয়— ছলনাকে আশ্রয় করে— "বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা।" দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী পুজো করে নারীদেরকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে, খানিকটা তোষামোদ করে রাখা হয়েছে। যে দেশে এত ঢাকঢোল পিটিয়ে দেবীদের পুজো করা হয় সেই দেশে নারীরা তাঁদের উপযুক্ত সম্মান পান না, নিজের সম্পত্তির, সন্তানের অধিকারটুকু পান না। কী আর কহিব সখী? বুজরুকিতে ধরাধাম চলিতেছে।
পিতারা ধর্মের আফিম খাইয়ে, নারীদের নিজেদের বশীভূত করে, প্রভু সেজে, তাঁদের স্বার্থ চরিতার্থ করছেন। অপরদিকে নির্বোধরা মুখ বুজে চুপ করে, অলক্ষ্মী, অসতী হয়ে যাবার ভয়ে কুঁকড়ে আছেন। আমাদের চোখের সামনে দুর্গার মডেল উপস্থাপন করে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে—পতিসেবা, সন্তান লালন-পালন, দুষ্টের বিনাশ সমস্ত কিছু দশভুজা দুর্গা হয়ে নারীদের করতে হবে।
আমাদের সমাজে অলক্ষ্মী মেয়ে, মন্দ মেয়েদের বড় জ্বালা। তাই লক্ষ্মী মেয়েদের কদর বেশি। বঙ্গসন্তানরা বউ হিসেবে লক্ষ্মী মেয়েদের পছন্দ করে বিয়ে করেন। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি জানিয়েছেন—"লক্ষ্মী সম্পদ ও সৌন্দর্যের দেবী। বৈদিক যুগে মহাশক্তি হিসাবে লক্ষ্মীকে পুজো করা হত। তবে পরবর্তীকালে ধনশক্তির মূর্তি নারায়ণের সঙ্গে তাঁকে জুড়ে দেওয়া হয়।" পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নিখুঁত ভাবে সংসার গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব, সম্পদে সংসার ভরিয়ে তোলার দায়িত্ব ‘লক্ষ্মী মেয়ের' স্কন্ধে চাপিয়েছেন।
আমাদের এই জঞ্জালে ভরা সমাজের পিতারা, ছলেবলে, কৌশলে কতকিছু ঘটিয়ে চলেছেন! কখনও দেবীর আরাধনা করছেন, আবার তাঁরাই নারীদের শারীরিক, মানসিক নির্যাতন করছেন। নারীদের নিজেদের কব্জায় রেখে, মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে, দুর্বল করে রেখে, মিছে 'দেবী' গড়ে, অভিনয় করে যাচ্ছেন। মিনমিন করে, ক্ষীণ কণ্ঠে কথা বলে, লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে হয়ে, দশহাতে সাড়ে পঞ্চান্ন হাজার কাজ করেন এমন, ঘরে-বাইরে আমরা বহুত দুর্গা-লক্ষ্মী দেখলুম। দেখেশুনে প্রাণমন জুড়িয়ে গেছে। কিন্তু এবার সত্যিকার অর্থে শক্তিরূপের বোধন হোক। লক্ষ্মীর কেবলমাত্র বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, অন্তরের সৌন্দর্য বিকশিত হয়ে উঠুক!
লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment